সৈয়দ মিজবাহ উদ্দীন
লেখক
বাংলাদেশের তরুণ সমাজের সবচেয়ে বড় হতাশার নাম যদি একটি শব্দে প্রকাশ করতে হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে “চাকরি”। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নেয়, স্বপ্ন দেখে একটি সম্মানজনক পেশার। কিন্তু এই স্বপ্নগুলো খুব দ্রুতই একটি দেয়ালে গিয়ে আছড়ে পড়ে—যার নাম “অভিজ্ঞতার শর্ত”।প্রায় প্রতিটি চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, সেখানে উল্লেখ করা আছে: “কমপক্ষে ২-৫ বছরের অভিজ্ঞতা আবশ্যক”, “অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে”, ইত্যাদি। অথচ এটা একটুও ভাবা হয় না, এই “অভিজ্ঞতা” একজন মানুষ কোথায় পাবে, যদি তাকে প্রথমবার কাজ করার সুযোগই না দেওয়া হয়?তখন প্রশ্ন জাগে, একজন তরুণ, সদ্য পাশ করা শিক্ষার্থী কোথায় গিয়ে সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, যদি তাকে চাকরির সুযোগই না দেওয়া হয়?চাকরিতে প্রবেশের আগেই যদি “অভিজ্ঞতা” শর্ত থাকে, তাহলে নতুনদের জন্য পথ কোথায়? কোনো মানুষই তো প্রথম দিন থেকেই অভিজ্ঞ হয় না। মানুষ শেখে কাজ করতে করতেই, ভুল করে, সংশোধন করে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ হয়। তাহলে কেন আমরা শিক্ষানবিসদের এই শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করি?এই সমস্যাটি শুধু একটি পেশায় নয়, সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান। শিক্ষকতা, ব্যাংকিং, প্রশাসন, আইটি, মার্কেটিং—সব জায়গাতেই একই শর্ত: অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার। যেন দেশের তরুণ সমাজ জন্ম থেকেই কোনো জাদুবলে ২ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে! অথচ বাস্তবে দেখা যায়, যারা প্রথম চাকরি শুরু করে তারাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে দক্ষ হয়ে ওঠে, সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্ত হয়, এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বড় সম্পদে পরিণত হয়।প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করছে। তারা স্বপ্ন দেখে একটুখানি সম্মানের চাকরির, পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। তারা দেখতে পায়, একটি সাধারণ অফিস সহকারী পদের জন্যও ২ বছরের অভিজ্ঞতা চাই। ফলে যারা আগে থেকেই কিছু না কিছু কাজের সুযোগ পেয়েছে, তারাই আগায়, আর বাকি বিশাল সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী পিছিয়ে পড়ে হতাশার অন্ধকারে।এই পরিস্থিতি তরুণদের শুধু মানসিকভাবে দুর্বলই করে না, বরং তাদের জীবনের গতিপথকেও বদলে দেয়। কেউ কেউ চাকরি না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করে, কেউ বাধ্য হয়ে স্বল্পমানের চাকরি গ্রহণ করে, কেউ আবার নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে চিরদিনের জন্য।এই চক্র থেকে বের হতে হলে আমাদের চাকরির বিজ্ঞপ্তির ভাষা এবং মনোভাব—দুটিই পরিবর্তন করতে হবে। “অভিজ্ঞতা আবশ্যক” এর পাশাপাশি “ফ্রেশাররাও আবেদন করতে পারবেন”—এই বাক্যটিও থাকা উচিত। প্রতিষ্ঠানের উচিত নতুনদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ শেখানোর ব্যবস্থা রাখা। এতে করে একদিকে যেমন দেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে, তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলোও দীর্ঘমেয়াদে দক্ষ ও অনুগত কর্মী পাবে।কিছু কিছু কোম্পানি ইতিমধ্যে “ইন্টার্নশিপ” বা “ট্রেইনি প্রোগ্রাম” চালু করেছে, যা একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এসব উদ্যোগ এখনো সীমিত এবং অল্প সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণ ও চাকরি-পূর্ব কর্মসূচি চালু করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কাজ শিখে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে।তরুণরাই ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি। তাদের কর্মদক্ষতায়ই একটি দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তাই চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে কেবল অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার না দিয়ে, নতুনদের জন্যও পথ খুলে দিতে হবে। সময় এসেছে—যেখানে “চাকরি না পেলে অভিজ্ঞতা হবে না, অভিজ্ঞতা না থাকলে চাকরি হবে না”—এই দুষ্টচক্রকে ভেঙে নতুনদের জন্য বাস্তব সুযোগ সৃষ্টি করার।আজকের নতুনরাই আগামী দিনের অভিজ্ঞ। যারা এখনো কিছু জানে না, তারাই একদিন জানবে, পারবে, গড়বে। যদি আমরা আজ তাদের সুযোগ না দিই, তাহলে আগামী দিনে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো অভিজ্ঞ কর্মীর অভাবে ভুগবে। কেবল অভিজ্ঞতার শর্ত দিয়ে আমরা এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে কর্মহীন করে রাখছি, অথচ তারাই হতে পারত দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ।চাকরির বিজ্ঞপ্তির ভাষা হোক মানবিক ও বাস্তবসম্মত। “অভিজ্ঞতা চায়, কিন্তু সুযোগ দেয় না”—এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। তরুণদের শেখার সুযোগ দিন, দায়িত্ব দিন, সময় দিন—তারা প্রমাণ করবে, তারা পারে।